পড়শি - বিদিশা ঘোষ
- বিদিশা ঘোষ
- Feb 27
- 12 min read
Updated: Mar 28

আকাশে কালো মেঘের অস্তিত্ব ঘর থেকে বেরনোর সময়ই চোখে পড়েছিল। আমার ছাতা নিয়ে বেরতে একদম ভালো লাগে না, সে পুড়ে যাওয়া গ্রীষ্মের দুপুর হোক বা স্নিগ্ধ শীতল শিরশিরে বৃষ্টির দিন। ভ্যাপসা গুমোট পেরিয়ে ঘাম যখন বৃষ্টির সাথে মিশে ফোঁটা কেটে মাথা থেকে পিঠ বেয়ে নামে, আমার অদ্ভুত ভালোলাগে, সেই ছোট্টবেলা থেকে। এটাই বোধহয় আমার যেখানে সেখানে ছাতা ফেলে আসার স্বভাবকে আরও বেশি প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু আমার পিসি! ঘর থেকে বেরলে সেটা বগলদাবা করে দেবেই। আর আমিও বেমালুম খালি হাতে হাঁটার অভ্যেসে তা যত্রতত্র দান করে আসি। আজই যেমন ছাত্রের বাড়ি জিনিষটা ভুলে চলে এলাম। ভুলে যাওয়াটা অবশ্য আমার প্রাচীন রোগ। এই যেমন পড়িয়ে ফেরার পথে কি যেন পিসি নিয়ে যেতে বলেছিল, সেটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। দুই তিনবার ফোন করলাম। ধরল না! এই হল দ্বিতীয় সমস্যা। পিসি সারাদিন ঘরেই থাকে অথচ ফোনটা ধরে না। বললে বলবে,
—"তোদের মতো সারাদিন মোবাইলের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করার অভ্যেস নেই আমার।
সকালে বেরনোর সময় দেখলাম উঠানে বাঁধা দড়ি দুটো ভর্তি জামা কাপড় মেলা, আর তুলসি গাছের পাশে ছেঁড়া মশারি ঢাকা নানান কারুকার্য করা বড়ি রাখা হয়েছে। বুঝতে পারছি এগুলোই আপাতত পিসির মোবাইলের গায়ে হাত না বোলানোর কারণ।
হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ঘরের কাছে এসে মনে পড়ল, সকালে চা দেওয়ার সময় পিসি একরকম হুমকি দিয়েই বলেছিল আজ যদি ফেরার পথে চিনি কিনে না নিয়ে যাই তাহলে বিকালে চা পাতাটা আধঘন্টা জলে ফুটিয়ে ছেঁকে কাপে ঢেলে দেবে। আমি এই নিয়ে পরপর তিনদিন হল ফেরার পথে কিনব কিনব করে রোজ ভুলে যাচ্ছি। আকাশের দিকে তাকিয়ে হিসাব কষে দেখলাম, বিষ্ণুদার দোকানে গিয়ে চা পাতা কিনে ফিরতে সব মিলিয়ে আরও মোটামুটি পনেরো মিনিট মতো লাগবে। ততক্ষণ আকাশ সবুর করবে কিনা জানি না, তবে ছাতা ফেলে এসে যদি ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরি, আজ ঘরেই আরেক দফা ঝড় বইবে। আর চিনিটা আজও মিস করে গেলে সত্যি বিকালের চা-টা মুখে তোলা যাবে না। আর বেশি না ভেবে চিনির পক্ষে রায় দিয়ে হাঁটা দিলাম উল্টো পথে।
সবে দোকান থেকে বেরিয়েছি এমন সময় একটা শুষ্ক গলায় পিছন থেকে হাঁক পড়ল,
—"জীবন নাকি?"
জীবন আমার মায়ের দেওয়া নাম। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর পিসি ছাড়া এই নাম ধরে ডাকার পৃথিবীতে আর কোনও মানুষ অবশিষ্ট নেই, বেশ চমকে উঠলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একটা উসকো-খুসকো লোক আমার দিকে তাকিয়ে। হ্যাঁ! আস্ত লোকটাই উসকো-খুসকো। কাঁচাপাকা দাঁড়ি, শুকনো দুটো ঠোঁটে একরাশ হাসি নিয়ে উজ্জ্বল দুটো চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। লোকটার চেহারা দেখে যে কেউ পাগল ভাবতে পারে। আমিও যে ভাবছিনা এমনটা নয়, তবে চোখে পাগলামির আভিজাত্যটা নেই। বরং আমাকে চিনে ফেলার বিশ্বাসটা বেশি তীব্র। তাকে দেখে চিনি বলে আমার ঠিক মনে পড়ল না, কিন্তু এড়িয়ে যাওয়াও যায় না। সে আমার এই ব্যক্তিগত নামটা জানে। জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে কিছু বলছেন?”
লোকটা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে হাতের ভর ছেড়ে সোজা হয়ে বসল বেঞ্চে।
—“তোকে না তো কাকে? এখানে আর কটা জীবন দেখতে পাচ্ছিস?”
এত কর্কশ উত্তর আমি ঠিক আশা করিনি। “না মানে আমার একটু তাড়া আছে।”
বেরিয়ে আসছিলাম, লোকটা আবার বলে উঠল, “তোদের বয়সের ছেলেপুলেদের এত তাড়া কিসের বলতো? যাকে দেখছি সেই ছুটছে! কেন? তোরা কি থামতে জানিস না! না কথা বলতে পারিস না!”
—“না না, বৃষ্টি নামবে, ভিজে যাব তাই তাড়াহুড়ো করছি আর কি...আর সত্যি বলতে আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না।”
লোকটা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি চিনতে পারিনি এটা তার কাছে একদম বিশ্বাসযোগ্য উত্তর নয়। প্রথমে আমার চিনতে না পারাটা তাকে অবাক করে দিলেও খানিকক্ষণের মধ্যেই তার চোখে হঠাৎ আবার পুরোনো হাসি ফুটে উঠল। শুকনো ঠোঁটের ফাঁকে বিড়ি চেপে ধরে সারা শরীরে দেশলাই খুঁজতে খুঁজতে প্রশ্ন করল,
—“আমাকে চিনতে পারছিস না? ছোটোবেলায় আমার বাগান থেকে কত পেয়ারা চুরি করে খেতিস! তা এখনো চুরি করে খাচ্ছিস না উপার্জন হচ্ছে?”
চুরি করে খাচ্ছি মানে? আমি পেয়ারা জিনিষটা কোনোদিনই ভালো খাই না। ছোটোবেলায় বন্ধুদের দেখতাম, শক্ত কষা পেয়ারা একটু নুনে ঠেকিয়ে কী আয়েশ করে খেত! আমার ঐ স্বাদটা কখনও মুখে ধরেনি।
—“সরি! আপনি বোধহয় আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন কারোর সাথে। মানে...আমি পেয়ারা... চুরি করে তো মোটেই না। আমি জীবনে গাছে উঠিনি।”
মুখ থেকে বিড়িটা পকেটে ভরে কেমন ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো তেড়ে এল আমার দিকে, “বুড়ো হয়ে গেছি বলে...যা খুশি তাই না! তুই এই আমার হাতে কতবার ধরা পড়েছিস জানিস?”
এবার বুঝতে পারলাম লোকটাকে প্রথমে দেখে যেটা মনে হয়েছিল সেটাই ঠিক। লোকটা পাগল। নইলে এমনভাবে কেউ তেড়ে আসে! আমি ভয়ে খানিকটা পিছিয়ে দোকানের সামনে রাখা ডাস্টবিনটায় ধাক্কা খেলাম।
ইতিমধ্যে আকাশে হালকা মেঘের ডাক শোনা যাচ্ছে। এখানে বেকার সময় নষ্ট করার মানে হয় না। আমি নিজেকে ধাতস্ত করে এগোলাম রাস্তার দিকে। হালকা ঝোড়ো হাওয়া রাস্তার ধুলোগুলোকে একপাক খাইয়ে সারা শরীরে ঢেলে দিয়ে চলে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। আমি কথা না বাড়িয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।
খানিকক্ষণ হাঁটার পর পিছনে থেকে আবার শুনতে পেলাম সেই ডাক। “ও জীবন! দাঁড়া না!”
পিছন ঘুরে মাথাটা গরম হয়ে গেল। এ তো আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল সকাল সকাল। সেই লোকটা হাসি মুখে চোখের কাছে হাত ঠেকিয়ে ধুলো বাঁচিয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমি না দেখার ভান করে পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করলাম। আড়চোখে একবার পিছন ফিরে দেখলাম লোকটা ছুটতে লেগেছে। পাগলের তাড়া খেয়ে ছোটাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কি না ভেবে বেশ জোরে হাঁটা শুরু করলাম। লোকটা খানিকক্ষণের মধ্যে একদম আমার ঘাড়ের কাছে এসে দাঁড়াল। “জীবন! আমাকে দেখে পালাচ্ছিস! তোর পিসি থাকলে ঠিক চিনত!”
আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পিসির কথা লোকটা জানে! পিছন ঘুরে দেখলাম লোকটা হাঁটুতে হাত রেখে শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে হাঁফাচ্ছে।
—“আপনি কে বলুন তো?”
এবার আমার মনেও একটু একটু সন্দেহ ধরা দিতে শুরু করেছিল। আমার ব্যাক্তিগত নাম শুধু না আমার পিসির কথাও জানে। লোকটা হাঁফাতে হাঁফাতে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, “কুণ্ডু! পুলক কুন...পুলক কাকু রে!”
আমার এখনো মনে পড়ছে না লোকটাকে কোথায় দেখেছি। নামটাও চেনা নয়। আমি কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না।
—“পিসি কেমন আছে?”
—“ভালো!”
—“কত বড় হয়ে গেছিস তুই। কিন্তু তোর চোখ দুটো এখনো একরকমই আছে! চোরের মতো, খালি এদিক আর সেদিক!”
লোকটা অদ্ভুতভাবে হো-হো করে হাসতে শুরু করল। এই চোর কথাটা শুনলেই আমার বিরক্ত লাগছে। কিন্তু লোকটা এত বিশ্বাসের সাথে আমাকে চোর বলছে যে আমিও মস্তিষ্কের অন্দরে ঢুকে একবার যাবতীয় স্মৃতির নথিপত্র ঘেঁটে ফেলেছি। সেখান থেকে এখনো কোনও চুরির প্রমাণ আমার স্মৃতিতে অন্তত মেলেনি। সকাল সকাল এ তো ভারি মুশকিলে পড়া গেল! এই উটকো বিষয়টা থেকে বেরনোর রাস্তা ভাবছিলাম, লোকটা প্রশ্ন করল,
—“তোর কাছে কিছু টাকা ধার হবে?”
এইবার আমি মতলবটা বুঝতে পারলাম। হয়ত কোনোভাবে আমাকে চেনে বা আমার পিসিকে চেনে। এখন এসব গল্প-টল্প ফেঁদে টাকা বের করার চেষ্টা! “না, মানে...”
লোকটা খপ করে আমার হাতের কব্জি চেপে ধরল।
—“দে না! ঐ কুড়ি টাকা মতো দিলেই হবে। আসার সময় তোর কাকিমাকে বলে এসেছি ফেরার সময় রাধানাথের স্পেশাল রসগোল্লা নিয়ে যাব। আজ ওর জন্মদিন তো! কিন্তু বেরনোর সময় মানিব্যাগটা... তোকে আমি কালকেই টাকা ফেরত দিয়ে আসব।”
লোকটা আমার হাত এত শক্ত করে ধরেছিল যে আমার এবার একটু ভয় লাগতে শুরু করল। এ কী বিপদে পড়লাম!
—“না মানে আমার কাছে টাকা নেই পুলক কাকু...” হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রবল চেষ্টা করতে করতে কথাটা বললাম।
লোকটা আমার কথার তোয়াক্কা না করে বড় বড় চোখে তাকাল আমার দিকে, “ঐ যে বিষ্ণুর দোকানে ফেরতটা পকেটে ঢোকালি!”
একেই বলে ডাকাতি! তাও দিনের আলোয়, সকালবেলা! চিৎকার করে লোক ডাকব? বলব কী? এই লোকটা আমার থেকে কুড়ি টাকা ছিনতাই করতে চাইছে? লোকে ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেবে? আমি বাধ্য হয়ে পকেটে হাত দিলাম। একটা পঞ্চাশ টাকার নোট! সেটা হাতে নিতেই লোকটা আমার হাত থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিল টাকাটা।
—“ওটা পঞ্চাশ টাকা!”
আমার এই করুণ আর্তি ওর কানে ঠিক করুণরূপে পৌঁছাল না। হাসি মুখে টাকায় একটা টোকা মেরে বলল, “হ্যাঁ! এতেও হবে।"
নোটটা নিজের বুক পকেটে ভরে হাসি মুখে পকেটের উপরে একটা চাপড় মেরে বলল, “হয়ে গেল! আমি যাচ্ছি! তুই এখানটা দাঁড়া। কোথাও যাবি না! আমি যাব আর আসব!”
লোকটা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে সটান উল্টো দিকে হাঁটা দিল। আমি কব্জিতে হাত বোলাতে বোলাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন ছিনতাইবাজের খপ্পরে পড়তে হবে জীবনেও ভাবিনি। লোকটা খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আরেকবার বলল, “কোথাও যাবি না কিন্তু! আমি এই যাব, আর আসব!”
আমিও ঘাড় নাড়লাম। লোকটা রাস্তার মোড় পেরিয়ে বড় বড় বাড়ির আড়ালে হারিয়ে গেল। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম রাস্তার মাঝখানে। দশ মিনিট কেটে গেল। পুলক কাকু এল না। নিজের বোকামোতে এবার আমার হাসিই পাচ্ছে! লোকটা টাকা নিয়ে কেটে পড়বে সেটাই তো স্বাভাবিক! আমি কেন তার অপেক্ষা করছি! কিন্তু কেন জানি না চলে যাব চলে যাব ভেবেও দুবার ঘাড় ঘুরিয়ে মোড়ের দিকে তাকিয়ে আবার অপেক্ষা করতে লাগলাম। এতক্ষণে লোকটাকে আমারও একটু চেনা বলে মনে হতে শুরু করেছে। অথবা হতে পারে লোকটার কথা ভাবছি বলে মস্তিষ্ক ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে আমাকে আরও বিভ্রান্ত করছে। হঠাৎ একটা ঝলকানিতে চমকে উঠল চারদিক। কিছুক্ষণের মধ্যেই গুড়গুড় শব্দ ভেসে এল আকাশ থেকে। নাহ! দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই! বাড়ির পথে পা বাড়াতে যাব শেষবারের মতো মোড়ের দিকে ঘাড় ঘোরাতেই মনটা হালকা হয়ে গেল। লোকটা যেমন হাসি মুখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনই হাসি মুখে ফিরছে। তার এক হাতে একটা প্লাস্টিক আর আরেক হাতে একটা শালপাতার বাটি। আমি তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। হাসি মুখে লোকটা আমার কাছে এসে বাটিটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। “পালাচ্ছিলি!”
—“না তো!” আমি হাত বাড়িয়ে সেটা ধরতেই লোকটা বুক পকেট থেকে দুটো দশ টাকার নোট আর কিছু খুচরো পয়সা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “দামটা একটু বেড়ে গেছে!”
আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। টাকাটা হাতে নিয়ে নিজের পকেটে রাখলাম। বাটিটা ফেরত দিতেই লোকটা চোখ পাকিয়ে তাকাল আমার দিকে। “এটা তো তোর জন্য আনলাম! খা!”
বাটির উপরের কাগজটা সরিয়ে দেখলাম তাতে একটা বড় সাইজের রসগোল্লা আর একটা কাঠের চামচ! আমি অবাক হয়ে তাকাতেই লোকটা দুবার ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “খা খা! এতদিন পর তোকে পেয়েছি! কত মার খেয়েছিস জানিস তুই আমার হাতে? গাছে উঠতিস আমি টেনে নামাতাম! পেয়ারা গাছটা থাকলে তোকে আজ পেয়ারাই খাওয়াতাম।”
আমার একটু হাসি পেল এবার। রসগোল্লাটা মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে দেখলাম লোকটা চোখ ভরে আমার খাওয়া দেখে তৃপ্তি সাধন করছে।
—“ভালো না!”
—“দারুণ!” ফোলা গালে চিবোতে চিবোতে হাসলাম। “থ্যাঙ্কইউ! চলি তবে!”
মনে হল যেন চলে যাব এই কথাটা বলে বিশাল একটা অন্যায় করে ফেলেছি আমি। আমার প্রশ্নে ভ্রু-যুগল একেবারে কাছাকাছি এনে লোকটা বলল, “মানে? কাকিমার সাথে একবার দেখা করবি না?”
—“না...আজ নয়। অন্য একদিন যাব!”
এতক্ষণের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী লোকটা আমার কথার বিশেষ পাত্তা দেয় না! আবারও দিল না। “আজই চ! তোকে কাকিমা দেখলে খুশি হবে!”
লোকটার ছোঁ মারা দুটো হাত আমার হাতের কব্জির দিকে এগিয়ে আসার আগাম বার্তা পেয়েই ঝট করে নিজের হাত দুটো পিছনে লুকিয়ে ফেললাম, “বৃষ্টি আসছে আজ! ছাতাও আনিনি! গেলে আটকে পড়ব!”
—“আমার ঘর থেকে ছাতা দিয়ে দেব! সমস্যা কি? চ!”
—“আপনি না আমাকে অন্য কারোর সাথে...”
—“আবার সেই কথা! তোকে আমার চিনতে ভুল হয়! চোর! মনে আছে তুই তিলের নাড়ু খেতে ভালোবাসতিস আর তোর কাকিমাও তোর জন্য তিলের নাড়ু বানাতো!”
তিলের নাড়ু খেতে আমি সত্যি ভালোবাসি। কাকিমা...কোন কাকিমা মনে নেই তবে এটুকু মনে আছে পিসি তিলের নাড়ু ভালো বানাতে পারে না।
—“আপনি জানলেন কি করে আমি তিলের নাড়ু ভালোবাসি?”
—“তোর বিশ্বাস হয়নি আমাকে, তাই না? আমার বাড়ি চ! পেয়ারা গাছটা যেখানে ছিল, এখন সেখানে সেটা নেই বটে... তবে তার শক্ত শিকড়টা এখনও মাটিতে আটকে রয়ে গেছে। এত শক্ত সেটা যে মাটি থেকে তোলাই গেল না! কত মানুষ চেষ্টা করল! ঐ শিকড়ের কাছে গেলেই তোর সব মনে পড়বে। চ না!”
লোকটার দুটো উজ্জ্বল চোখ আমি কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। বিশ্বাস যে এত তীব্র হয় আমার জানা ছিল না। সত্যি বলতে আমার নিজেরই কেমন একটা ইচ্ছা করছিল লোকটার বাড়ি যাওয়ার। কাকিমার সাথে দেখা করার। সেই পেয়ারা গাছটার ফেলে যাওয়া শিকড়টা দেখার, যেটা ওর স্মৃতিতে আমাকে তস্করের তকমা দিয়েছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবলাম, তারপর তাকালাম আকাশের দিকে। ঘাড় নামিয়ে বললাম, “ঠিক আছে। চলুন!”
হাসি মুখে এগোলাম তার সাথে। রাস্তায় যেতে যেতে লোকটা অনবরত একটাই কথা বলতে থাকল, কাকিমা নাকি আমাকে দেখলে ভীষণ খুশি হবে। আমার মনে মনে ততক্ষণে একটা ভয়ও জমতে শুরু করেছিল। কাকিমা যখন চিনতে পারবে যে আমি সেই চোর নই, তখন পুলক কাকু কিভাবে নিজের বিশ্বাসের প্রতারণা মেনে নেবে! মনে মনে চাইছিলাম কাকিমাও যেন আমাকে সেই চোরের সাথে গুলিয়ে ফেলে। শিকড়টা দেখার পর যখন আমি সেটা চিনতে পারব না, তখন কী কঠিন পরীক্ষাটাই না আমাকে দিতে হবে! অভিনয় করতে হবে। তা সে নাহয় করব।
রেললাইন টপকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। তারপর একটা সরু গলি। সেই গলির একদম শেষ প্রান্তে পুলক কাকুর বাড়ি। গলিতে ঢোকার সময় পুলক কাকু কানে কানে বলল, “আজ জানিস যাওয়ার সময় তোর কাকিমার সাথে একটু ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল। রাগ অভিমান দেখালে কিছু মনে করিস না!”
—“না না।” আমার বুকে জুড়ে পেট-ফাটা হাসি উথলে এল। “চলুন না, কাকিমা আমাকে দেখলে বোধহয় আপনাকে অতটা রাগ দেখাবেন না...”
—“ঠিক বলেছিস!”
মিনিট পাঁচ হেঁটে পৌঁছলাম বাড়ির কাছে। বাইরের মরচে পড়া গেট খোলার সাথে সাথে মনে হল আমার মাথাটা যেন হালকা চক্কর দিয়ে গেল। মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশ যেন কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছে না দিন শুরু হয়েছে না শেষের পথে। পুলক কাকু হাসি মুখে সামনের খালি ঘাসে ঢাকা জমি পেরিয়ে এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে। আমি এগোতে পারলাম না। আমার মনে হল যেন গুল্ম ঘাসের জঙ্গলে আমার পা দুটো আটকে গিয়েছে। এক ঝটকায় যেন আমার ভিতরটা কেমন তরঙ্গের মতো ঢেউ দিয়ে গেল। বাড়িটা আমি আগেও দেখেছি। সামনের বড় রাস্তা দিয়ে যাতায়াত আমার অনেক দিনের। জীবনে কখনও আমি এই গলিটায় ঢুকেছি বলে মনে পড়ে না; কিন্তু এই অনাদর জমে থাকা বাড়িটার কঙ্কালটা আমার বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে! পুলক কাকু পিছন ঘুরে হাত নাড়তেই যেন আমার মাথায় এক অদৃশ্য আত্মা ভর করে বসল। আমি তার পিছু পিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম। কর্কশ কলিং বেলটা বাজতেই বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠল! এবার কাকিমার সাথে দেখা হবে! আমি কি তাকে চিনতে পারব? সে কি আমাকে চিনতে পারবে? আমি তো এই লোকটাকেও চিনতাম না। আর সেই পিয়ারা গাছটা! সেটার মাটিতে আটকে যাওয়া শিকড়টা কোনদিকে! ভাওতার অরণ্যে যেন সত্যি আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। যা সত্যি নয় তা আমাকে অনুভুতি দিচ্ছে কেন? ধুকপুকে হৃদয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম দরজার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে দাঁড়াল একটি মেয়ে। বয়স আমার মতোই হবে। কিন্তু তার মুখে একটা অদ্ভুত প্রাণহীন ভাব। ফ্যাকাশে মুখটা চোখের কালির সাথে মিলে বেশ একটা বিরক্তির দলিল পেশ করছে। মেয়েটি আমাকে একচোখ দেখে নিয়ে পুলক কাকুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “কোথায় গিয়েছিলে না বলে?”
অতিথির জীবিকা চুরি হলেও সে অতিথি বলে কথা! পুলক কাকুর অপ্রস্তুত মুখ দেখে তার মনের কথাটা বুঝতে পারছিলাম। ব্যাপারটা সামলানোর জন্য বলল, “আরে কে এসেছে দেখ! জীবন!”
—“কে জীবন?” মেয়েটি তাকাল আমার দিকে, “কে আপনি!”
কী উত্তর দিই আমি! বৃদ্ধের বিশ্বাসে সায় দেওয়া যায়, কিন্তু আমি জানি সেটা মিথ্যা। এমন ক্লান্ত দুটো চোখে আরও প্রতারণা দেব?
মেয়ের পাল্টা প্রশ্নে এবার পুলক কাকু একটু চটে গেল। “তোকে কি বাইরে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করে তারপর ঘরে ঢুকতে হবে? তোর মা কোথায় রে?”
মেয়েকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে “কিগো! কে এসেছে দেখ! জীবন!” বলতে বলতে পুলক কাকু ঢুকে গেল ঘরের ভিতর। মেয়েটি কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমাদের দুজনেরই মনে এখন একই প্রশ্ন। "আমি কে?" কিছুক্ষণ নীরবে উত্তর খুঁজে মেয়েটি “আসুন!” বলে ভিতরে চলে গেল। আমি হতভম্ব দাঁড়িয়ে রইলাম চৌকাঠে। আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছিল এই বাড়ির দরজার সামনেই একটা সিঁড়ি আছে। তার ডান দিকে একটা বড় ঘর। সেই ঘরে একটা সবুজ রঙের সোফা থাকে। সেটা একটু খানি ছেঁড়া। পায়ের উপর বিশ্বাস করে ভিতরে প্রবেশ করলাম আমি। ভিতরের অন্ধকার বাইরের আঁধারেকে বেশ টেক্কা দেয়। সেই অন্ধকারে ভিতরটা দেখে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার জোগাড় হল আমার। দরজার বাম দিকে সত্যি একটা সিঁড়ি। তার ঠিক বিপরীতে একটা বড় ঘর। মেয়েটি আমার ঢোকার আগেই ঘরের আরও অন্দরে চলে গেছে। সিঁড়ির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দরজা দিয়ে বড় ঘরটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেন জানিনা ভীষণ ঢুকতে ইচ্ছা করছিল ঐ ঘরটায়। ঐ দুটো মানুষ যে কোথায় হারিয়ে গেল ভিতরে, খানিকক্ষণ কোনো সাড়া-শব্দ পেলাম না। আমার আর সবুর হল না, এগোলাম ঘরটার দিকে। বাইরে থেকে যেমন ভেবেছিলাম ভিতরটা ঠিক সেইরকমই। আমার সময়-স্থান-জ্ঞান সব যেন লোপ পেল। জানলার গ্রিল, দেওয়ালের একটা খোপ; সবই তো আমার চেনা। ঐ খোপটায় পুরোনো কাগজপত্র আবর্জনার মতো ঠুসে ঠুসে গুঁজে রাখা। আমার মনে মনে একটু যেন রাগ হল। এইখানে তো বই থাকার কথা! আবর্জনা কে জমিয়ে রেখেছে! মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পায়ের নিচে একটা মোজাইক পাথরে খোদিত ফুল। আমি জানি না পৃথিবীর নকশায় এই ফুল কোথাও দেখেছি কিনা, কিন্তু এই ফুল আমার ভীষণ চেনা। ঘুরতে ঘুরতে ঘরের এক কোণে একটা ফ্রেমে বাঁধাই ছবি চোখে পড়ল। কাঁচের উপর জানলা দিয়ে ঠিকরে আশা আকাশের ছবি এমনভাবে প্রতিফলিত হয়েছে যে ফ্রেমে আটকা পড়া চরিত্রগুলোকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আরও কাছে এগিয়ে গেলাম আমি। এবার পরিষ্কার দেখতে পেলাম। ব্যাস! নেশা যেন একদম জ্বলন্ত বাস্তব হয়ে ধরা দিল চোখের সামনে। পুলক কাকু আর কাকিমার ছবি। এক অদ্ভুত প্রেমে চোখ জলে ভরে উঠল আমার। আমিই তো সেই চোর! মনে পড়ল আমার সেই পেয়ারা চুরি করার কথা। সে এক আদিম জীবনের গল্প! পুলক কাকু তখন অবশ্য পুলক কাকু ছিল না। নাটকে ও হয়েছিল যোগ্যনাথ কুণ্ডু। আর আমি হয়েছিলাম নিতাই। এই ঘরেই রিহার্সাল হ'ত! তখন আমার বয়স ছয় কিম্বা সাত! এই ঘরেই তৈরি হয়েছিল সেই পেয়ারা চুরি করার দৃশ্য আর নিতাইয়ের সাথে যোগ্যনাথের আলাপ! আমার প্রথম স্টেজে ওঠা! শো-এর দিন অত লোক দেখে কী ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম আমি। যোগ্যনাথ চরিত্রটা আমার ভয়ঙ্কর লাগত, তাই পুলক কাকুকেও ভয় লাগত। সেদিন শো-এর আগে গ্রিনরুমে বসে প্রথম দেখলাম, আমার চেনা পুলক কাকু কেমন তিলে তিলে যোগ্যনাথ কুণ্ডু হয়ে উঠল। আমি বসে দেখছিলাম খানিকটা দূর থেকে। পরচুল মাথায় যোগ্যনাথ তাকাল আমার দিকে। “কিরে! ভয় লাগছে?”
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। হাত নেড়ে কাছে ডাকল পুলক কাকু। সামনের আয়নাতে দেখলাম নিজেকে আর সামনে বসা বহুরুপীকে। কানে কানে বলল, “আমারও একটু একটু ভয় লাগে! কিন্তু দেখবি স্টেজে সব ভয় কেটে যাবে।”
মাথা নিচু করলাম আমি, “আমার যদি ধুতি খুলে যায় সবার সামনে!”
—“সবার? কই? শুধু তো তুই আর আমি!”
জোরে ঘাড় নেড়ে প্রতিবাদ করলাম আমি। “অনেক লোক তো! সবাই বসে আছে দেখবে বলে।”
জোরে হেসে উঠল পুলক কাকু, “স্টেজে আলো জ্বললে আর ওদের দেখা যায় না! সব অন্ধকার। ঐ আলোর নিচে শুধু তুই, আমি আর পেয়ারা গাছ। মনে থাকবে?”
বড় করে মাথা নেড়ে দিলাম আমি। আমাকে সেদিন বসিয়ে মিষ্টি খাওয়াতে খাওয়াতে আরও অনেক কথা বলেছিল পুলক কাকু। সেসব আমার মনে নেই, তবে মনে আছে সেই থার্মোকলে বানানো নকল রঙ করা পিয়ারা গাছটার কথা!
তারপর ঠিক কবে থেকে রিহার্সালে আসা বন্ধ হল মনে নেই। বেমালুম এই পূর্বজন্মের কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ আমার পিছনে একটা হালকা কাশির শব্দ শুনতে পেলাম। পিছন ঘুরে দেখি সেই মুখময় বিরক্তি মাখা মেয়েটি দাঁড়িয়ে। হাতে তার কিছু টাকা। সেই টাকা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “কিছু মনে করবেন না! মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবার স্মৃতি লোপ পেয়েছে। যাকে তাকে পরিচিত বলে দাবি করে।”
আমি হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিলাম। কি উত্তর দেব বুঝতে পারছিলাম না। বললাম, “না, উনি আমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন। আমিই ওকে চিনতে পারিনি।”
বাড়ি থেকে বেরনোর সময় মেয়েটি একটা ছাতা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “বাবা আপনাকে এটা দিতে বলল।”
হাসি মুখে ছাতাটা হাতে নিলাম। অনেক প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছিল পুলক কাকুর মেয়েকে, কারণ আমি তাকেও চিনতে পেরেছি। ফ্রক পরে দরজার বাইরে থেকে বুড়ো-খোকাদের রঙ্গ তামাশা সে আবডাল থেকে উপভোগ করত। কখনো সামনে আসত না। আমরাও তাকে কখনো হিসাবের মধ্যে রাখিনি, কিন্তু সে ছিল, আজও আছে এখানে।
বাইরে তখন বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধুলোর ডেলা বাঁধতে শুরু করেছে। আমি ছাতা মেললাম। পকেটের মোবাইলটা অনেকক্ষণ বাজছে। পিসি! ছাতাটা ঘাড়ের ফাঁকে গুঁজে পকেটে রাখা চিনির প্যাকেটটার তলায় মোবাইল ফোনটা আবিষ্কার করলাম। সেটা কানে ঠেকাতেই গর্জন করে উঠল পিসি। “তুই কি আজ ঘরে ফিরবি না?”
—“আসছি! চা পাতা কিনতে ভুলে গিয়েছিলাম। ওটা আনতেই দেরি হয়ে গেল।”
—“চা পাতা?”
—“না না চিনি!” কথার খেই হারিয়ে যাচ্ছিল আমার। পকেটে একবার উঁকি মেরে দেখলাম, চা পাতা না চিনি!
—“ছাতাটা আছে তো না আবার ফেলে এলি?”
—“না আছে। ভুলিনি। আসছি!”
খুব সুন্দর লেখা, যদিও প্রধান চরিত্র দুটির সাথে মিল নেই আমার তাও এমন অনেক কথা আর শব্দ আছে যা ছোটবেলার অনেক কিছু মনে করিয়ে দিয়েছে। এই গল্পটা আমার আজীবন মনে থাকবে।