ব্যক্তির জন্ম না হলে উপন্যাসের জন্ম হয় না। এদেশের সমাজে ব্যক্তির জন্মের আগেই উপন্যাস লেখার ঔপন্যাসিক অনুশীলনী শুরু হয়ে যায়। ফলে প্রায় একশো বছরের অধিক কাল ধরে বাংলা উপন্যাস প্রথমে ফিউডাল হাভেলিতে এবং পরে মুৎসুদ্দির দালানে হামাগুড়ি দিতে দিতে শেষমেশ মানিক বাড়ুজ্জ্যর হাতে নাকি বাস্তবতার আমিষান্ন গ্রহণ করে। ভাগ্যিস বাড়ুজ্জ্য মশাই জন্মেছিলেন, নইলে বাংলা উপন্যাস সাবালক হতে আরও কত টাইম নিত কে জানে! অতএব আপাতত কাজ চালানোর মতো করে আরেকবার স্মরণ করে নেব যে, উপন্যাস হল ব্যক্তি-সমাজ-বিবৃত-সংলাপ-আখ্যানের গদ্যায়িত পারিভাষিক গোত্রনাম। --- মোটামুটি ব্যাপারটা এতদিন পর্যন্ত এরকমই ছিল। কিন্তু অজিত রায়ের "যোজন ভাইরাস" পড়ার পর ব্যাপারটা একেবারে বদলে গেল। সমুদয় বদলে গেল, সেটাই বলা ভালো।
'যোজন ভাইরাস' ব্যক্তির এবং ব্যক্তির কথন্যাস। এবং এর লেখক অজিত রায় মশাই, স্বয়ং একজন স্বঘোষিত 'আরবান', তথাচ ব্যক্তি। এই আরবান লেখকের পাল্লায় পড়ে বাংলা আরবান-উপন্যাসের ভিত নড়ে গেল। উপন্যাস, বিশেষত বাংলা উপন্যাস নিয়ে আরও অনেক কথা, আরও অনেক দূরের কথা জন্ম খেলো। আরো অনেক ঋতুরঙ্গ আরো অনেক বর্ষার কুলপ্লাবী বানভাসি, আরো অনেক নিদাঘশোষিত খরা, শীতার্ত রাতের স্মৃতিভারাতুরতার সাক্ষী হতে হল বাঙালি পাঠককে। আরো অনেক ভঙ্গুরতা, জৈবনিক অপরতার রক্তাক্ত প্রত্নলেখ পাতায় পাতায় দৃশ্য করতে হল পাঠককে। বাখতিন সাহেব উপন্যাস নিয়ে অন্য স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছিলেন আমাদের। উপন্যাসে ইউরোপীয় মডেলের ব্যক্তি, তার উত্থান ও ভঙ্গুরতাকে বড় চমৎকার ব্যাখ্যা করে গেছেন তিনি, কিন্তু ব্যক্তিকে নিয়ে এই ভয়ংকর খেলা অব্দি তিনি ভাবেননি। তাঁর কাছে ব্যক্তি বড়জোর সমাজসৃষ্ট এবং সমাজসিক্ত একজন। ব্যক্তি যে এহেন বহুস্বরিক, সমাজবাহী জৈবনিক শতদল ঝর্ণার ধ্বনিও হয়ে উঠতে পারে একজন লেখকের হাতে, এ অব্দি তিনি ভাবেননি। অজিত রায়ের 'যোজন ভাইরাস' মারফৎ আমরা বখতিনের কাল থেকে অতি দ্রুত অন্য এক 'অপর' পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হলাম। তৃতীয় বিশ্বের এক ক্ষুদ্র ভূখণ্ডেও এক সমাজহীন সমাজের প্রেতচ্ছায়া মেলে ধরলেন অজিত রায়। পাঠকের স্বপ্নসুখ নিষিদ্ধ হয়ে গেল। লেখক দেখালেন, যুথচারী-সমাজস্বপ্নের বৈজ্ঞানিক অঙ্গীকারও আজ শব্দমাফিয়া-কবলিত। সবকিছুই ফালা-ফালা হয়ে গেছে, আড়াআড়ি, লম্বালম্বি।
যোজন ভাইরাস
Jojon Virus
Jojon Virus - Ajit Roy
অজিত রায়

















