বাঁশির রাখাল - অভিজিৎ সুর
- Papanguler Ghor
- 3 days ago
- 3 min read
Updated: 2 days ago

ছেলেটা চেয়ে থাকে নদীর দিকে, উজান ভাটির সব খবরই নদীর কাছে আছে। তবু সে কথা বলে না, নাকি বলার থেকে চলায় তার ইচ্ছের প্রকটতা অধিক? তথাপি কোনো নিভৃত ভঙ্গিমায় অকস্মাৎ কোনো তাৎক্ষণিক পরিভ্রমণের অদৃষ্ট বন্ধনে কচিত কখনও ঘাটের কাছে গল্প বলে নদীর জল। ছেলেটা কি শুনতে পায় সেই গল্প? নাকি সে শুনবে বলে আসে সেই কথকথা যার ভাবনা আর শালীনতা বোধ হৃদয়ে মিশে থাকে গভীর রাতের জেগে থাকা নক্ষত্রের মতো, যেখানে কোনো সহজ সুরেলা আবাহন — যারা শোনে তাদের জন্যই শুধু।
ছেলেটার একটা অন্য ভূবন ছিল যখন সে ছোটো ছিল। ইস্কুল ছুটির দিনে সে গরুর বাচ্চা নিয়ে চরাতে যেত বাড়ির পাশের মাঠে, হাতে ধরা থাকতো বাচ্চাটার গলায় বাঁধা দড়ির শেষ প্রান্ত। গরুর বাচ্চা যেদিন প্রথম বাড়ির বাইরে যেত সেদিন প্রথমটা যেন কি এক ধাঁধায় ধাঁধিয়ে যেত, চুপ করে যেত, বোধহয় বিশালতা, মাঠের, তাকে গ্রাস করত। এই এত বড় আকাশখানা তার মনেও কোনো স্থির অথবা অস্থির দ্যোতনা আনতো কিনা কে জানে। কে জানে তার আর কি কি চিন্তন খেলে যেত। ছেলেটা তার গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, গাভীর সন্তান মানুষের বন্ধু হয়ে যেত। বন্ধুই তো, ছেলেটা তো মালিক নয়। মালিক কি সে জ্ঞানও তার ছিল না। মালিক সে কখনও হতেও চায়নি, বড় হয়েও না। ওই মাঠে ছেলেটা একটা সুর শুনতে পেত। কোথায় বাজতো তা সে জানতো না, কে বাজাতো তাও সে জানতো না, তবু সে শুনতে পেত। তার খালি মনে হ'ত ওই আকাশের ওপারে কোনো দেশ আছে, সেখানে থেকেই আসে বাঁশির সুর। আকাশে উড়ে যাওয়া এরোপ্লেন দেখতে দেখতে সে ভাবতো একদিন সে উড়ে যাবে ওই বাঁশির সুরের দেশে, শিখে আসবে সেই সুর, তারপর বাঁশি বাজিয়ে গরু চরাবে। ছেলেটার বাড়িতে একটা ক্যালেন্ডার ছিল, তাতে মাথায় শিখীপাখা এক বালক বাঁশি বাজাচ্ছে আর তাকে ঘিরে আছে ধেনুদল। একদিন সেও, ছেলেটা ভাবে, ওইভাবে রাখাল হবে, ওই মাঠে, ওই সুরে, ওই বাঁশের বাঁশিতে।
একদিন যায় দুদিন যায় গরুর বাচ্চাটা ক্রমে ক্রমে ঘাসে মুখ দিতে দিতে, একটুখানি একটুখানি, খেতে শিখে যায়; ছেলেটা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। বাচ্চাটার প্রথম ঘাস খাওয়ার দৃশ্য তার জীবনে আঁকা হয়ে থাকে, তার মুখে লেগে থাকে শরতের নরম রোদ মায়ের আদরের মতো। বাচ্চাটার মুখ ধরে সে খুব কষে আদর করে দেয়, অবলা জীবন নির্মল মমতায় ভিজে যায় আদরে আদরে। ছেলেটা বাড়ি ফিরেই বিশ্বজয়ের চিৎকার করে, মা, ও আজ ঘাস খেয়েছে।
মা হাসে, বলে, তোর আর কিছু হবে না তুই গরুই চরা। ছেলেটাও হেসে ফেলে।
নদীর জলে পাতা ভেসে যায়, বাসি ফুল, পাখির পালক, আর সময়; সময়ের নদীতে স্রোতের বড় টান।
গরু চরানোর মাঠটাতে একটা শিউলি গাছ ছিল, শরতের ভোরে তার নীচেটা থাকতো সাদা হয়ে। ছেলেটা সকাল হলেই ছুট দিতো গাছের কাছে, ঝুড়ি হাতে, সঙ্গে তার ছোটো বোন। পাখ-পাখালিরা সবে তাদের ডানা মেলে উড়ে গেছে দিনের সন্ধানে। ওই যে বিশাল অশথ দাঁড়িয়ে থাকে প্রপিতামহের মতো, সেই যেন কতকাল কত বছর ঝড় আর বৃষ্টি, তার সূর্য তার চাঁদ ধার করে এনে সামাল দিয়েছে দুরন্ত সময়কে। এখনো নিজের কোটরে ভালোবেসে আগলে রাখে টিয়ার ছানা। রাতের পেঁচা চৌকিদারি করে অশথের মগডালে।
ছেলেটা আর তার বোন ভিজে ঘাসে পা ডুবিয়ে কুড়োয় শিউলি, ঝুড়ি ভর্তি হয়, তার চেয়েও বেশি ভর্তি হয় মন। সেই এক চঞ্চল সত্তা যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা পেড়ে ফেলে শরতের সকালে একটি অবুঝ বালক আর এক ততোধিক অবুঝ বালিকাকে উপহার দেয় শারদীয়ার শুভেচ্ছা; সুগন্ধ ঢেলে দেয় প্রথম আলো, শিশির প্রণাম করে প্রণিপাত, মঙ্গল শঙ্খ তখনি বেজে ওঠে কারোর ঠাকুরঘরে, হয়তো আজ লক্ষ্মীবার।
ছেলেটা আর তার বোন বাড়ি ফিরে শিউলির পাপড়ি ফেলে দিয়ে বোঁটাগুলো হাতে ঘষতে থাকে। হাত থেকে এক অমলিন সুবাস বেরিয়ে আসে, হাত হয়ে ওঠে বাসন্তী। ছেলেটা তাকায় তার বোনের দিকে, চুল ধরে এক টান, বোনও এক ঘুষি বাগিয়ে দেয় দাদার পিঠে। দাদা 'হি হি' করে ওঠে, বলে, তোর থেকে আমার রঙ বেশি। বোন বলে, কাঁচকলা, আমার বেশি।
মা দাঁড়িয়ে থাকে দরজার আড়ালে, তার চোখে তখন শুধুই বর্তমান, ভবিষ্যতের দাবি-দাওয়া তখন শূন্যকার। নতমুখে হতাশ কেজো সংসার, ঘরোয়া টানাটানি যেন গিলেছে সকালের রোদ। মা দ্যাখে, দেখেই যায়, মায়ের আঁচল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে শরৎকাল।
একটা নৌকো চলে গেল, কচিৎ, কদাচিৎ এখনও দ্যাখা যায় দাঁড় বাওয়া। ছেলেটা এখনও বসে আছে নদীর ঘাটে। গল্প অথবা না-গল্প, আবার হয়তো তাও নয়। ছেলেটাকে অবশ্যই এখন আর ছেলে বলা যায় না, তার শরীরে বয়স জমেছে; এখন তার সিঁড়িতে উঠতে হাঁটুতে লাগে। এই না-গল্প আর না-জীবন নিয়ে তার কোনো খেদ ছিল না যদি সে সেই বাঁশিটা শুনতে পেত আজও। তার এরোপ্লেনে চড়ে বাঁশির দেশে যাওয়া হয়নি, তুলে নিয়ে আসা হয়নি সেই সুর। এনেই বা কি হ'ত? তার বাড়ির গোয়ালঘর কবেই উঠে গেছে, গাভী আর তার সন্তান কেউই নেই ঘাস জমিতে, চারণভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে দাম্ভিক কংক্রিট। হয়তো মাটির অনেক অন্ধকার নীচে আজও গুমড়ে মরে শিউলির অবশিষ্ট মৃত শেকড়।
আরো অনেক মৃত স্বপ্নের মতো ছেলেটার রাখাল হওয়া হয়নি, অনুভবে মিশে যায়নি 'ওদের সাথে মেলাও যারা চড়ায় তোমার ধেনু।'
নদীর জলে ভেসে যায় গল্প, জীবন, ছন্দ, ভেসে যায় চিতাভস্ম, যেভাবে এক রাতে ভেসে গেছে তার জন্মদাত্রীর শরীর পোড়া ছাই— শ্মশানচিতার ভস্ম মেখে গৌরী হল শ্মশানবাসী।
ছেলেটার বাঁশি তাকে ফাঁকি দিয়ে হারিয়ে গেছে, সে তার সন্ধানও করেনি। ইদানিং এই ঘাটের কাছে সে আর এক বাঁশির সুর শুনতে পায়, তার সুর ভিন্ন, লয় ভিন্ন, মাত্রা ভিন্ন, উপকথায় যাকে বলে পাড়ের বাঁশি।
Comments