সমাজ-রাষ্ট্র-অধিকার - সংযুক্তা রায়
- সংযুক্তা রায়
- Feb 16
- 4 min read
Updated: Mar 23

আমরা মানুষ ও সামাজিক জীব। মনুষ্যজীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক সামাজিক চরিত্র। আমরা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পরস্পরের সাথে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হই। পরস্পরের উপর ভিত্তি করেই সমাজ গড়ে ওঠে। সুষ্ঠ সমাজজীবন প্রত্যেকেরই কাম্য ও তার জন্য প্রয়োজন সুস্থ জীবনযাত্রাকে সুনিশ্চিত করা।
মানুষের সামাজিক চরিত্রের প্রকাশ ও তাকে ধরে রাখার জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন হয় নিয়ম-কানুনের, আবার সেই নিয়ম-কানুনের যথাযথ প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রের। প্রাচীনকালে যখন রাষ্ট্র বলে কিছু ছিল না, তখন ছিল নগররাষ্ট্র। আমাদের এই পৃথিবী-সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর আবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সভ্যতার আদি থেকেই মানুষ সুশৃংখল ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনে আগ্রহী। আর এই জন্য মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্র তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমান সভ্য জগতে রাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন। রাষ্ট্র নামক সংগঠন বহু পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমান অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। রাষ্ট্রের মানুষের সামাজিক জীবন, রীতিনীতি, সামাজিক প্রথা, অনুশাসন, রাষ্ট্রের আইন কানুনের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। সমাজে বাসরত প্রতিটি নাগরিকের স্বার্থ, উদ্দেশ্য, প্রয়োজন, বিভিন্ন কার্যকলাপ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। রাষ্ট্র ও সমাজের মূল একক মানুষ ও তার অধিকার। নাগরিক অধিকার গণতন্ত্রের একটি অংশ। জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে আইনের চোখে সবাই সমান। কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের আইনস্বীকৃত সদস্য হিসেবে পাওয়া পদমর্যাদাকে নাগরিকতা বলে। নাগরিকত্বের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি সেই রাষ্ট্রের অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
নাগরিকতা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে ব্যক্তির অর্জিত পরিচিতি, গুণাবলী, সম্মান, ও অধিকার। নাগরিক যদি যথাযথভাবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে তাহলে তার নাগরিকতার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
নাগরিকতা অর্জনের দুটি পদ্ধতি রয়েছে — একটি জন্মসূত্রে নাগরিক, ও অপরটি অনুমোদনসূত্রে নাগরিক। আবার, জন্মসূত্রে নাগরিকের দুটি ভাগ — জন্মনীতি ও জন্মস্থাননীতি। জন্মনীতি অর্থাৎ সন্তান যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন পিতা মাতার নাগরিকত্বের দ্বারা সন্তানের নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয়। পিতা-মাতা যে রাষ্ট্রের নাগরিক, সন্তানও সেই রাষ্ট্রের নাগরিক। অর্থাৎ বৈবাহিক সম্পর্ক ও রক্তের বন্ধনের উপর ভিত্তি করে জন্মনীতি গড়ে ওঠে। জন্মস্থান নীতি অর্থাৎ এই নীতি নির্ধারিত হয় জন্মস্থানের উপর ভিত্তি করে। সন্তান যে স্থানে জন্মগ্রহণ করবে তার উপর ভিত্তি করে নাগরিকতা নির্ধারিত হবে। কতগুলো শর্ত পালনের মাধ্যমে এক রাষ্ট্রের নাগরিক অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকতা অর্জন করলে তাকে অনুমোদনসূত্রে নাগরিক বলা হয়। অনুমোদন সূত্রে নাগরিকতা কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষে অর্জন করা যায়। শর্তগুলি— ১)যে রাষ্ট্রের নাগরিক হতে ইচ্ছুক সেই রাষ্ট্রে বিবাহ করতে হবে। ২)কোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে হবে। ৩)যে রাষ্ট্রে থাকবে সেই রাষ্ট্রের সরকারি চাকরি লাভ করতে হবে। ৪)যে রাষ্ট্রে থাকবে সেই রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে হবে। ৫) ব্যক্তিকে চরিত্রবান হতে হবে। ৬) যে রাষ্ট্রে থাকবে সেই রাষ্ট্রের জমি বা কোনো সম্পত্তি ব্যক্তির নিজ নামে অর্জন করতে হবে। ৭) যে রাষ্ট্রে, যে দেশে থাকবে সেখানকার ভাষা জানতে হবে। তবেই নিয়ম অনুযায়ী নাগরিকের বৈধতা পাওয়া সম্ভব হবে। অনুমোদনসূত্রে নাগরিকতা লাভ করতে হলে কোনো বিদেশীকে উক্ত এক বা একাধিক শর্ত সাপেক্ষে রাষ্ট্রের নিকট আবেদন করতে হবে। আবেদন অনুমোদন হলে আবেদনকারী ব্যক্তি সেই রাষ্ট্রের নাগরিক বলে গণ্য হবে। অনুমোদনসূত্রে নাগরিকতা অর্জনের শর্ত বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হয়। যেমন— আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচবছর, ফ্রান্সে কমপক্ষে পাঁচ বছর, আর্জেন্টিনায় দুই বছর স্থায়ী ভাবে বাস করলে আবেদনকারী ব্যক্তি নাগরিকতা লাভ করে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকতা লাভ করতে আবেদনকারী ব্যক্তিকে অবশ্যই ইংরেজি ভাষা জানতে হবে। অর্থাৎ নাগরিকতা বলতে যে ব্যক্তি স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রে বাস করে, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে, রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুন মেনে চলে সে-ই রাষ্ট্রের নাগরিক।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ও চুক্তি অনুযায়ী কোনো নাগরিক তার নিজের রাষ্ট্রের নাগরিকতা হারিয়ে অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকতা অর্জন করতে পারে। কোনো রাষ্ট্র যুদ্ধে অন্য রাষ্ট্রের এলাকা দখল করে সেই এলাকার শাসন হস্তগত করলে বিজয়ী এলাকার নাগরিকরা পূর্ব রাষ্ট্রের নাগরিকতা হারিয়ে জয়ী রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ ইজরায়েল প্যালেস্তাইন সংঘাত, ইউক্রেন রাশিয়ার সংঘাতের কথা বলা যায়। আবার, নাগরিকতা অর্জনের জন্মনীতি ও জন্মস্থাননীতি এক সাথে মেনে চলার জন্য দ্বৈত নাগরিকতা সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ ফ্রান্সের কোনো দম্পতির সন্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলে ফ্রান্স জন্মনীতি অনুসরণ করে বলে সন্তানটি ফ্রান্সের নাগরিক হবে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় নীতি মেনে চলে বলে সে যুক্তরাষ্ট্রর নাগরিক হবে। একই সাথে দুটি রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়াকে দ্বৈত নাগরিক বলা হয়। দুটি রাষ্ট্র তার কাছে আনুগত্য দাবি করতে পারে। পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর ব্যক্তি যেকোনো একটি রাষ্ট্রের নাগরিকতা বর্জন করে অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকতা অর্জন করতে পারে।
অধিকার ভোগ ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েই একজন নাগরিক পূর্ণাঙ্গ বিকশিত হয়। অধিকারের মাত্রা ও কর্তব্য পালনের দ্বারা একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্বরূপ লাভ করা যায়। তাই নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর জড়িত।
কোনো ব্যক্তির ন্যায়সঙ্গত ইচ্ছে মতো কাজ করার ক্ষমতাই অধিকার। অধিকার কথাটি সামাজিক চেতনাবোধ থেকে উদ্ভুত। অধিকার অর্থাৎ 'দাবি।'
রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত জনকল্যাণমূলক কিছু মৌলিক সুযোগ-সুবিধা, যা ছাড়া ব্যক্তি জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশও সম্ভব নয়। অধিকার অর্থ যথেচ্ছাচার নয়, কারণ যথেচ্ছাচার সভ্য সমাজে কখনই গ্রহণীয় নয়।
অধিকার বলতে মূলত ব্যক্তির নৈতিক অধিকার, আইনগত অধিকার, সামাজিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, ধর্মীয় অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার বোঝায়। এই প্রতিটি অধিকার ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার।
ব্যক্তির অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষ এই অধিকার প্রকৃতি থেকে পায়। এই অধিকার নিয়েই সে জন্মগ্রহণ করে।
নাগরিক অধিকার অর্থে সমাজের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য-দায়িত্বও বোঝায়। নাগরিকরা যেমন রাষ্ট্রপ্রদত্ত অধিকার ভোগ করে, তেমনই রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকেরও কর্তব্য আছে। রাষ্ট্র যেমন নাগরিকের রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার দিচ্ছে তেমন নাগরিকেরও দায়িত্ব ও কর্তব্য আইন মেনে চলা, কর দেওয়া। রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তিই সু-নাগরিক। স্বাধীনতা, সাম্য ও অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা কর্তব্য পালন করার মধ্যেই থাকে। সুস্থ উন্নত সমাজব্যবস্থা মূলত নাগরিকের সচেতন কর্তব্যবোধের উপরেই নির্ভরশীল।
সমাজ জীবনকে সুন্দর ও উন্নত করা সমাজের প্রতিটি মানুষের সামাজিক কর্তব্য। সুষ্ঠু রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নাগরিকেরও রাজনৈতিক কর্তব্য পালন করতে হয়।
অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর সম্পর্কিত। অধিকার ভোগ করতে হলে কর্তব্য পালন করতে হয়। অধিকার উপভোগ ও কর্তব্য পালনই নাগরিক জীবনের পূর্ণতা। একমাত্র কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েই অধিকার উপভোগ করা যায়।
একজনের কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে অন্যের অধিকার সুনিশ্চিত হয়। আমার যেমন অধিকার সম্পত্তি ভোগের তেমনই কর্তব্য অন্যের সম্পত্তির উপর হস্তক্ষেপ না করা। আমার যেমন নিরপেক্ষ থাকার অধিকার আছে তেমনই কর্তব্য অন্যের জীবনে নিরাপত্তার পথে বাধা সৃষ্টি না করা।
রাষ্ট্র সকল অধিকারের উৎস। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রতিটি নাগরিককে এগিয়ে আসতে হয়। একজন নাগরিক জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমাজে বাস করে। সমাজ ব্যক্তিকে সুযোগ-সুবিধা দেয়। আবার সমাজ জীবনকে সুস্থ সুন্দর গড়ে তোলা নাগরিকেরই দায়িত্ব। অধিকার ও কর্তব্য দুটিরই উৎস সমাজ। অর্থাৎ সমাজ-রাষ্ট্র-অধিকার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। একটি ছাড়া অন্যটি অর্থহীন।
সমাজের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে। সেগুলি প্রত্যেকটাই রাষ্ট্রের ইচ্ছা ও নির্দেশের উপর নির্ভরশীল। আবার রাষ্ট্রকেও সমাজের প্রথা রীতিনীতিকে শ্রদ্ধা করে চলতে হয়। সমাজজীবনের মূলনীতি উপেক্ষা করলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়ের উদ্দেশ্য সুশৃংখল সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা ও ব্যক্তির উন্নতি করা। ব্যক্তির উন্নতি হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি হবে। আবার রাষ্ট্রের উন্নতি সু-নাগরিকের উপর নির্ভর করে।
Congrats for such an informative, free flowing, Pristine and clearly illustrated writting.❤️❤️
নাগরিক কর্তব্য নিয়ে তথ্য সমৃদ্ধ লেখনি।একইসাথে ভাষাও বেশ সাবলীল সব স্তরের পাঠকের কাছে বোধগম্য হবে।
সহজ... সাবলীল লেখা। লেখকের বক্তব্য সুস্পষ্ট এবং তথ্যসমৃদ্ধ ।
Khub informative, anek kichu notun bishoy janlam .
Abhinandan Writer ,🙏💐
অসাধারণ লাগলো, তথ্যসমৃদ্ধ হলাম 😊